পবিত্র রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ মুসলিম উম্মাহর কাছে এক মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানবজাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্ম ও জীবনের শিক্ষা। তাঁর আগমন কেবল মুসলিম সমাজের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক নতুন আলো, মুক্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে আসে।
নবীজির আগমনের সময় আরব সমাজ ছিল নৈতিক ও সামাজিকভাবে চরম অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। গোত্রভিত্তিক বিভাজন, দাসপ্রথা, নারী নির্যাতন, মদ্যপান ও জুয়া সমাজের দৈনন্দিন অংশ ছিল। কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, দুর্বল ও নিঃস্ব মানুষের শোষণ ছিল নিয়মিত। ধর্মীয় অন্ধকার, কুসংস্কার এবং নৈতিকতার অভাব তখন সর্বত্র বিদ্যমান। এই কঠিন সময়ে আল্লাহর রহমতস্বরূপ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন মহানবী (সা.), যিনি মানুষকে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার আলোক পথে পরিচালিত করেছিলেন।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে “আমুল ফীল” বা হাতির বছর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জন্মের কয়েকদিন আগে ঘটেছিল আব্রাহার নেতৃত্বে হাতি বাহিনী কাবা আক্রমণ করার চেষ্টা, যা অলৌকিকভাবে ব্যর্থ হয়। নবীজির জন্মের পর তিনি পিতৃহারা হন, এবং শৈশবেই মাতৃহারা হন। দাদা আবদুল মুত্তালিব ও পরে চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে তিনি বড় হন। ছোটবেলা থেকেই সততা, ধৈর্য, দয়া ও সত্যনিষ্ঠা তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠেছিল, যার জন্য মক্কার মানুষ তাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি প্রথম ওহি লাভ করেন। এই মুহূর্ত থেকে নবুওয়াত শুরু হয়। তিনি মানুষকে আহ্বান জানালেন এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে, মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে এবং ন্যায় ও মানবতার পথে চলতে। প্রথমে দাওয়াত সীমিত আকারে হলেও পরবর্তীতে প্রকাশ্যে ইসলামের বার্তা প্রচার করতে থাকেন। এতে মক্কার অভিজাত শ্রেণি ক্ষুব্ধ হয় এবং নবী ও তাঁর অনুসারীরা চরম নির্যাতনের শিকার হন।
দীর্ঘ নির্যাতনের পর নবীজির নেতৃত্বে মুসলিমরা হিজরত করে মদিনায় গমন করেন। মদিনায় তিনি ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধানভিত্তিক রাষ্ট্র, ‘মদিনা সনদ’, প্রতিষ্ঠা করেন। এই সনদে মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবাইকে সমান অধিকার ও নিরাপত্তা দেওয়া হয়। মদিনায় নবীজির শাসনব্যবস্থা মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও কল্যাণকেন্দ্রিক ছিল। এটি প্রমাণ করে যে ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, মানবজাতির কল্যাণে পূর্ণাঙ্গ জীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দিশা দেয়।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন মানবতার জন্য এক অমর দৃষ্টান্ত। তিনি শিখিয়েছেন—মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানো, নারীর মর্যাদা রক্ষা করা, দাসদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সবার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে অন্যের উপকারে আসে।” তাঁর শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল না শুধু ধর্মীয় আচারে; পারিবারিক জীবন, সামাজিক সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রনীতি—সব ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য এখানে নিহিত যে, এটি কেবল আনন্দ-উৎসব নয়, বরং আত্মসমালোচনা ও নবীর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের এক মহৎ উপলক্ষ। মুসলিমরা এ দিন মাহফিল, মিলাদ, দোয়া ও সীরাতুন্নবী আলোচনা আয়োজন করে থাকেন। এই আনুষ্ঠানিকতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় নবীর জীবন ও আদর্শকে জীবনে ধারণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নবীর চরিত্র, তাঁর দয়া, সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহনশীলতা অনুসরণ করা হলো এ দিনের মূল শিক্ষা।
আজকের বিশ্বে যখন হানাহানি, সহিংসতা, বৈষম্য ও বিভাজন বেড়ে চলেছে, তখন নবীজির শিক্ষা আমাদের জন্য বিশেষ প্রাসঙ্গিক। তিনি শিখিয়েছেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সহনশীলতা, মানবিকতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মহত্ব। যদি আমরা সত্যিকারভাবে তাঁর আদর্শে চলি, তবে সমাজে অন্যায় ও বৈষম্যের অবসান সম্ভব। শান্তি, ভালোবাসা ও মানবতার কল্যাণেই নিহিত তাঁর জীবনের চিরন্তন বার্তা।
ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন মুসলিম উম্মাহর উচিত নবীর জীবনকে অনুকরণ করার শপথ নেওয়া। দরিদ্র, নিঃস্ব ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো, সততা, ন্যায় ও দয়া প্রদর্শন করা—এসবই নবীর শিক্ষা অনুসরণের নিখুঁত রূপ। তাঁর জীবন মানে কেবল ধর্মীয় আদর্শ নয়, বরং সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবিকতার দিকনির্দেশনা।
মহানবী (সা.) মানবজাতির জন্য এক অনন্ত আলোকবর্তিকা। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করলেই বিশ্ব শান্তি, ন্যায় ও মানবতার আবাসস্থল হয়ে উঠবে। ঈদে মিলাদুন্নবীর উপলক্ষে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত—নবীর জীবনকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা, তাঁর দেখানো পথে চলা এবং মানবজাতিকে আলোর পথে পরিচালিত করা। এটি কেবল ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং মানবতার প্রতি আমাদের মৌলিক দায়িত্বও বটে।
এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী শুধু একটি উৎসব নয়, বরং মানবতার মুক্তি, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার এক চিরন্তন বার্তা। আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি সিদ্ধান্ত যদি নবীর শিক্ষা দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে পৃথিবী সত্যিকার অর্থেই আলোকিত, সুন্দর ও মানবিক হবে। নবীজির জীবন ও শিক্ষা আজও আমাদের জন্য সর্বকালীন দিশারী।
আপনার মতামত লিখুন :