ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫
প্রাথমিকের নারী শিক্ষক

তবে কি শিশুদের মাতৃস্নেহে শিক্ষার প্রয়োজন নেই?

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫

তবে কি শিশুদের মাতৃস্নেহে শিক্ষার প্রয়োজন নেই?

শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়; এটি মানুষের মেধা, মনন, নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের প্রধান ভিত্তি। বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরুতে যে পরিবেশ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, তার প্রভাব থাকে দীর্ঘদিন। তাই শিশুশিক্ষায় পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি দরকার মাতৃস্নেহময় ও মমতাপূর্ণ পরিবেশ।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিরাপদ ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশে শিশুদের শেখার আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায়। স্নেহভরা শিক্ষক-শিক্ষিকার সান্নিধ্যে তারা বইকে বোঝা মনে করে না; বরং আনন্দের উৎস হিসেবেই গ্রহণ করে। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী শিশুশিক্ষায় নারী শিক্ষকের উপস্থিতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষক যত বেশি থাকেন, শিক্ষার্থীদের শেখার দক্ষতা ও বিদ্যালয়ে স্থায়িত্ব তত বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ সরকারও এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০১৯ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায় নারী শিক্ষকের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেছিল। এর আগে নারী শিক্ষকের কোটা ছিল ৪০ শতাংশ এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক। পরে তা উন্নীত করে উচ্চ মাধ্যমিক করা হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে এবং শিশুরা স্নেহময় শিক্ষকের সংস্পর্শে আসতে থাকে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যদিও ঝরে পড়ার হার এখনো একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে।

কিন্তু সম্প্রতি জারি হওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫-এ নারী কোটা পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, নারী, পুরুষ বা পোষ্য—কোনো কোটাই রাখা হয়নি। কেবল মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য ৭ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। বাকি ৯৩ শতাংশ পদে নিয়োগ হবে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে। এই পরিবর্তনকে ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে—তাহলে কি শিশুশিক্ষায় আর মাতৃস্নেহের প্রয়োজন নেই?

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (২০২৪), দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৫টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ এবং শিক্ষক আছেন প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষক ২ লাখ ৩৫ হাজার, পুরুষ শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার। সার্বিকভাবে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি হলেও চরাঞ্চল, হাওর বা পাহাড়ি এলাকায় এখনো নারীর উপস্থিতি কম। সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র ৪৭ শতাংশ এবং পুরুষ ৫৩ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নারী শিক্ষক বাড়ালে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত হয়। ভারতের প্রশাসনিক ডেটা ব্যবহার করে গবেষক মুরালিধরন শেঠ প্রমাণ করেছেন, নারী শিক্ষক বাড়লে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের ফলাফলও উন্নত হয়। আবার ইউনেস্কোর জেন্ডার ব্রিফে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক স্তরে নারী শিক্ষকের হার গড়ে ৬৮ শতাংশ। নেপাল ও ভুটানে নারী শিক্ষক বাড়ানোর ফলে ঝরে পড়ার হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরদিকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো দেশে নারী শিক্ষক কম থাকায় কন্যাশিশুদের বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণও সীমিত হয়ে আছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় নারী কোটা বাতিল হওয়া নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত এক পরামর্শক কমিটি সম্প্রতি সুপারিশ করেছিল, প্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদও জানিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমতে থাকায় এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার চাইলে নারী কোটাকে পুরোপুরি বাদ না দিয়ে অন্তত ৫০ শতাংশে সীমিত রাখতে পারত। এতে মেধার প্রতিযোগিতা যেমন অটুট থাকত, তেমনি কোমলমতি শিশুদের জন্য স্নেহময় শিক্ষার পরিবেশও নিশ্চিত হতো। পাশাপাশি চর, হাওর ও পার্বত্য এলাকায় বিশেষ কোটায় নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে প্রান্তিক অঞ্চলের শিশুরাও সমান সুযোগ পেত।

শিশুশিক্ষার লক্ষ্য শুধু পাঠ্যজ্ঞান অর্জন নয়; বরং স্নেহ, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা। তাই শিশুদের হৃদয় গঠনে মাতৃস্নেহভিত্তিক শিক্ষা অপরিহার্য। নারী শিক্ষক কমিয়ে নয়, বরং বাড়িয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত ও মানবিক সমাজের পথে এগিয়ে নিতে হবে।

আমার ক্যাম্পাস

Link copied!