একটা দেশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত শিক্ষকদের। সবচেয়ে বেশি বেতন থাকা উচিত শিক্ষকদের। দেশের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক হওয়া উচিত শিক্ষকদের। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে নিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হওয়া উচিত। দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং সৃজনশীল ব্যক্তিদেরই হওয়া উচিত শিক্ষক।
কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে কী?
সবচেয়ে অবহেলিত শিক্ষকরা। সবচেয়ে বেশি বৈষম্য আছে শিক্ষা ক্যাডারে। সবচেয়ে বেশি পক্ষপাতিতভাবে নিয়োগ হয় শিক্ষক নিয়োগে। কোনো চাকরি-পদ না পেয়ে অবশেষে যোগ দেন শিক্ষকতায়। আমাদের দেশে এমনও উদাহরণ আছে — কোনো চাকরি-পদ না পেয়ে বেকার কয়েকজন মিলে কলেজ খুলে শিক্ষক হয়ে বসে পড়েছেন।
রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে শিক্ষকদের সামনে গিয়ে নেতারা সবাই দাঁড়িয়ে কথা বলবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কক্ষে ঢুকতে হলে মন্ত্রীকেও অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু আমার সোনার বাংলাদেশে দেখি— মেট্রিক পাস কন্সটেবলও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পেটায়।
রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, গবেষক ও শিক্ষাবিদদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবে রাষ্ট্রপরিচালনার পরামর্শ নিতে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকরা ভালো পোস্টিং বা ভালো দায়িত্ব কিংবা কলেজগুলোতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কমিটির দায়িত্ব পেতে স্থানীয় এমপিকেও ‘স্যার স্যার’ করে মুখে ফেনা! কারণ ভালো একটা দায়িত্ব পেলে দুই পয়সা ধান্দাপানি বেশি হবে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির এত বেশি পরিমাণে বৃদ্ধির প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা— বছর বছর আমলা বানালেও আদর্শিক মানুষ তৈরি করতে পারেনি এখনও। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমরা একটা সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারিনি। দেশের সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের পাঠ্য-পুস্তক পরিবর্তন হয়। স্বাধীনতার ইতিহাস পরিবর্তন হয়, স্বাধীনতার ঘোষক পরিবর্তন হয়, সংবিধান পরিবর্তন হয়। এসব বন্ধ না হওয়া অবধি জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে, ইউরোপের ছেলে-মেয়েরা যখন বিজ্ঞান কিট নিয়ে গবেষণা করে তখন আমাদের দেশের ক্লাসরুমে স্বাধীনতার ঘোষক আর মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হয়। শিক্ষককেও ক্লাসরুমে পড়ানোর আগে ভাবতে হয় তার শিক্ষার্থী কোন দলের সমর্থক। কারণ মতের বিরুদ্ধে গেলে শিক্ষককেও তুলে নিয়ে পানিতে ফেলে দেয়ার নজীর হয়েছে।
ভারতের এপিজে আবদুল কালাম শিক্ষক থেকে রাষ্ট্রপতি হন — আর আমাদের দেশে শিক্ষকরা হয় পরিমল!
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে যে দেশের প্রযুক্তি যত উন্নত, তারা গ্লোবাল ভিলেজে তত প্রভাবশালী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে টিকে থাকতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আর একটা দেশের প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি করে কারিগররা— সেই কারিগর হল শিক্ষক।
আমার দেশে শিক্ষকদের বেতনের জন্য আন্দোলন করতে হয়, প্রমোশনের জন্য আন্দোলন করতে হয়। নিজের অধিকার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। দেশের শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত না করে এই জাতির মুক্তির কোনো অন্য উপায় নেই।
প্রস্তাবনা :
> দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইন করে সব ধরনের শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
> শিক্ষক হতে হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক।
> শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে বেশি রাখতে হবে।
> শিক্ষা ক্যাডারে সব ধরনের বৈষম্যের চিরতরে কবর দিতে হবে।
> শিক্ষকদের কেউ অসম্মান করলে তাৎক্ষণিক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
> শিক্ষক নিয়োগ সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে হবে।
> যেকোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে।
> শিক্ষক নামধারী কিছু টাউট-বাটপার, ছ্যাঁচরা, অমেরুদণ্ডী চতুষ্পায়ী প্রাণীদের চাকরিচ্যুত করতে হবে।
> বাজেটে শিক্ষাখাতে জিডিপির অন্তত ৭ থেকে ১০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে।
> সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে।
> দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা যেন শিক্ষকতায় আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
> কর্মক্ষেত্রে এবং বাইরে শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
> প্রতি বছর শিক্ষক দিবসে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গোপন ভোট ও গবেষণা ও বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রমের উপর নম্বর দিয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে। এটি জাতীয় পর্যায়েও রাষ্ট্রে সবচেয়ে সেরা শিক্ষক মনোনয়ন হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশে নিরপেক্ষভাবে শিক্ষকতা করার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। এতসব ঝুঁকি নিয়েও যারা ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ‘আমলা’ না বানিয়ে মানুষ বানাতে চান— তাদের প্রতি শিক্ষক দিবসে আমার অন্তরের অগাধ শুভেচ্ছা।
আপনার মতামত লিখুন :