এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছে এর দায় শুধু তাদের একার নয়। এ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির দলিল। স্কুল কলেজগুলোয় কী পড়ানো হয়? কোচিং কেন করতে হবে? শুধু কী স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাই কোচিং ফাঁদে আটকা? না।
উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্যও কোচিং যেন বাধ্যতামূলক? কয়েকটি কোচিং সেন্টার যদি কিছু পড়িয়ে ভর্তিযোগ্য করতে পারে, সরকারের কী কোনো করণীয় নেই? নৈরাজ্যকর এক সমাজের কাছে শিক্ষার্থীদের পাস ফেল এবং ভর্তির যোগ্যতা তৈরির মেশিন তুলে দেওয়া যেকোনো সরকারের শিক্ষানীতি ত্রুটির মানচিত্র।
নব্বইয়ের দশকের আগে কোচিং করে ভর্তির ব্যবস্থা ছিল না। তখন কী মেধাবী ছিল না? তখন কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতেন?
রাষ্ট্রের আজগুবি শিক্ষাব্যবস্থার খেসারত দিচ্ছে আমাদের সন্তানরা। এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ঘটল ফল বিপর্যয়ের পর নানা কথা সামনে আসছে। আমরা কেমন মেধাবী চাই? পাস ফেলের বিষয়টি এমন হয়ে গেছে যে, একদিকে একজনের বিয়ের বাড়ির উৎসব, অন্যদিকে একই বাড়িতে একজনের মৃত্যুর শোক।
আমাদের সন্তানদের মধ্যে যারা পাস করেছে তারা হয়তো ভাগ্যবান। এক অর্থে তাই। কিন্তু ভর্তিতে তাদের জন্য সুবিধা কতটা আছে তাও কিন্তু ভাবনার বাইরে নয়। এবার জিপিএ-৫ খুব কম পেয়েছে। যা পেয়েছে তার চেয়েও ১৫ হাজার আসন কম আছে সরকারি মেডিকেল, প্রযুক্তি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার ওপর জিপিএ-৪ সাড়ে তিন থেকে চার পর্যন্ত চার লাখের মতো রয়েছেন শিক্ষার্থী। তারাও ভর্তি পরীক্ষার জন্য যোগ্য। আসন কম। প্রার্থী বেশি। ব্যবসার সুযোগ চলে যায় কোচিং-এর হাতে। তার মানে পাস করা শিক্ষার্থীরাও দিশেহারা।
নানান প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিযোগিতার মধ্যে অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি পাস করা শিক্ষার্থীরা কি তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে?
অপরদিকে, যারা ফেল করেছে তারা শুধু এক বছর পিছিয়েছে তাই নয়, এক বছরের জুনিয়রদের সঙ্গে বসে তাদের পরীক্ষা দিতে হবে। তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে ভাবতে কোনো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এক বছর তাদের আলাদাভাবে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষকরা নার্সিং করবেন মানবিক আচরণ করবেন এমনটিও নয়।
আগের সরকারের সময়ে দেওয়া হতো বোনাস পাস আর বোনাস জিপিএ। মানে সরকারের ওপর সন্তুষ্ট থাকা আর কি। শিক্ষার্থীরা গোলমালে যাবে না। রাস্তায় নামবে না। এটা তো ছোট দিক। ক্ষতির বিষয় ছিল সত্যিকারের মেধাকে সংকুচিত করা।
কারণ গড়পড়তা জিপিএ বা ৮০-৯০ ভাগ পাস করা শিক্ষার্থীদের মাঝে কে কতটা মেধাবী তা যাচাই করার কারিগরদের ওপর অলিখিত আদেশ থাকতো পাস দিয়ে দাও। ফলে যথাযথভাবে মূল্যায়নের সুযোগটা পেতেন না।
আর এখন? রাষ্ট্র কী পেরেছে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সারিয়ে তুলতে? পাঠ্যপুস্তক আত্মস্থ করতেই গলদঘর্ম। সমসাময়িক কোনো বিষয় তাদের শেখার সুযোগ কতটা ছিল? এবার ভর্তি পরীক্ষার পর দেখা যাবে কী শিখিয়েছে আর কী ধরনের প্রশ্ন এসেছে।
যাদের অর্থকড়ি আছে তারা দেশের বাইরে তাদের সন্তানদের পড়াতে পারেন। আমাদের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী বা সমাজের একটা অংশ তাদের সন্তানদের দেশের বাইরে পড়ান। এই শ্রেণিই আবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করার দায়িত্ব নেন। ফলে নিজের জন্য যা ভালো পরের জন্য তা তদ্রূপ হওয়ার কথা থাকলেও তা কি আর এই গলদ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হয়?
রাজপথে পড়ে থাকেন শিক্ষকরা। তাদের দাবি যৌক্তিক কিনা সেটা বিবেচনা করতেও ভিড়ের মধ্যে অনেক সময় চলে যায়। ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার ঘা না সারালে জাতির মেরুদণ্ড বাঁকা হতেই থাকবে।
লেখক: নগর সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর

আপনার মতামত লিখুন :