জুলাই জাতীয় সনদে নেই ১০৬ অনুচ্ছেদ, সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের ফসল ঘোষণা
এক বছরের প্রচেষ্টা ও আট মাসের সংলাপ শেষে প্রণীত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫। আগের দুটি খসড়ায় উল্লেখ ছিল—‘সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।’ তবে চূড়ান্ত সনদে এই অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন ভাষ্যে বলা হয়েছে—‘গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।’
আগামী শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে এ সনদে স্বাক্ষর হবে। মঙ্গলবার রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনদের চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হয়েছে, যাতে আর কোনো পরিবর্তন আনা হবে না বলে জানানো হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের জন্য প্রথম খসড়া পাঠানো হয়। পরে ১১ সেপ্টেম্বর সংশোধিত খসড়া দেওয়া হয় এবং সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দুই দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
এই সংলাপগুলোর সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রক্রিয়া। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর দাবি, সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত হওয়ায় এটি সাংবিধানিক সরকার, এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এই সরকারের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নেই।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল বলছে, এই সরকার আদালতের মতামতে নয়, বরং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত হয়েছে, যেখানে জনগণই সংবিধান গ্রহণ বা বাতিলের ক্ষমতার অধিকারী। তাই এই সরকার সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদ কার্যকর করতে পারে।
বিএনপি এই ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি, সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা একমাত্র সংসদের। সরকারকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে ঐকমত্য কমিশনের একজন দায়িত্বশীল সদস্য বলেন, “১০৬ অনুচ্ছেদের বৃত্তে প্রবেশ করতে চাই না।”
চূড়ান্ত সনদে আগের খসড়ার সঙ্গে মূল পার্থক্য হলো ভাষাগত কিছু পরিবর্তন ও সংস্কার সিদ্ধান্তের শ্রেণিবিন্যাস। মোট ৮৪টি সংস্কার সিদ্ধান্তের মধ্যে ৪৭টির জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, আর বাকি ৩৭টি কার্যকর হবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। সনদের শেষ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, এই ৩৭টি সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার অবিলম্বে বাস্তবায়ন করবে।
সনদে যুক্ত হয়েছে ‘ঐকমত্যের ঘোষণা’ নামে একটি নতুন অংশ। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট স্বীকৃতি পেয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ নয়টি সংস্কার বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত রাখা হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বরের খসড়ায় এই নোট অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখন ৫(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই জাতীয় সনদের (কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ) সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি।’ কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এতে কে কোন বিষয়ে কী অবস্থান নিয়েছে, তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
পুরো সনদে একমাত্র ব্যক্তির নাম হিসেবে আছে শেখ হাসিনা। সনদের পটভূমিতে লেখা হয়েছে—‘জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’ আগের খসড়ায় শুধু ‘স্বৈরাচারী শাসক’ বলা হয়েছিল। কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যেভাবে ইয়াহিয়া খানের নাম ছিল, তেমনি শেখ হাসিনার নাম রাখা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বৈরতান্ত্রিক পথে না হাঁটে।
সনদে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের কালরাতের উল্লেখ যুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথাটি সংশোধন করে এখন বলা হয়েছে—১৯৭৮ সালে উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ১৯৭৯ সালে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া জামায়াতের প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্ত করা হয়েছে—‘২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠা তাণ্ডবে দেশে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।’
সংলাপে পুলিশি সেবা জনবান্ধব করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে, যা আগের খসড়ায় ছিল না।
সাত দফা অঙ্গীকারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই বলা হয়েছে—জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসেবে সনদকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হবে, আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে, জুলাই অভ্যুত্থান সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে, এবং সইকারী দলগুলো আদালতে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না।
আপনার মতামত লিখুন :