মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। আগামীকাল সকাল আটটা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে। এর আগে নানা মহলে আলোচনা চলছে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেওয়ার মতো ‘ফ্যাক্টর’ বা নিয়ামকগুলো নিয়ে।
এই নিয়ামকগুলো কী কী তা বোঝা যায়, প্রার্থীদের ইশতেহার ও ভোটার সংখ্যার দিকে নজর দিলে। পাশাপাশি একটি বিশেষ ‘ভোট ব্যাংক’কেও গুরুত্ব দিচ্ছেন কয়েকজন প্রার্থী।
গতকাল রোববার ছিল প্রার্থীদের প্রচারণার শেষ দিন। এদিনও সব প্রার্থীর নজর ছিল নারী ভোটারদের নজর কাড়ার দিকে। কারণ, ডাকসুতে এবার মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ ছাত্রী। ফলে বড় পদগুলোর প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ছাত্রীরাই।
ভোটের ব্যাংক কোচিং সেন্টার
নির্বাচনে ভিপি পদে ছাত্রীদের ভোট বেশি পাবেন কে, কোন হলের ভোট কার পক্ষে যাবে, কার দিকে ঝুঁকবেন জগন্নাথ হলের বিপুল সংখ্যক ভোটার– এমন নানা আলোচনার ফাঁকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংয়ে পড়ান এমন প্রার্থীরা। বিশেষ করে ভিপি পদে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের সমীকরণ মেলাতে ‘কোচিং ফ্যাক্টর’ সামনে আসছে।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং ইউসিসিতে ক্লাস নেন। তিনি এ কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও যুক্ত। আবার ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে মূলত ছাত্রশিবির। সেখান থেকেও অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সাদিক কায়েম সেখানে তাঁর সুযোগ দেখছেন। এ ছাড়া, স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেনও ইংরেজি পড়িয়ে ক্যাম্পাসে বেশ জনপ্রিয়। তাঁরও রয়েছে ‘ভোট ব্যাংক’।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ফোকাস ও ইউসিসিতে কোচিং করে সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে ফোকাস থেকে এক হাজার ৭৫০ জন এবং ইউসিসি থেকে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসাবে গত তিন বছরে এ দুই কোচিং সেন্টারে ক্লাস করা অন্তত আট হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন এখানে। তারা সবাই এ নির্বাচনে ভোটার।
সরাসরি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইংরেজি পড়ান স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন। ফেসবুকে তাঁর অনেক অনুসারী। তারা চাকরির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিখতে শামীমের ভিডিও ক্লাস দেখেন নিয়মিত। বিভিন্ন ব্যাচে শামীমের অনেক শিক্ষার্থীও আছেন।
বড় ফ্যাক্টর ছাত্রীরা
ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯, যা মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ছাত্রীদের পাঁচটি আবাসিক হলের মধ্যে শুধু রোকেয়া হলেই পাঁচ হাজার ৬৬৫ ভোট। এ ছাড়া, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে দুই হাজার ১১০টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে দুই হাজার ৬৪৫, শামসুন নাহার হলে চার হাজার ৯৬ এবং কবি সুফিয়া কামাল হলে ভোটার চার হাজার ৪৪৩টি।
এই বড় সংখ্যক ভোট ব্যাংক বিবেচনায় প্যানেলগুলো তাদের ইশতেহারেও নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে। প্রচারণায়ও এই দিকগুলো তুলে ধরেছেন। নারীরা যাতে সাইবার বুলিংয়ের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন প্রার্থীরা।
ছাত্রদলের প্যানেলের ইশতেহারে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি হলে স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট, মেডিকেল সেন্টারে নারী চিকিৎসক, সান্ধ্য আইন বিলোপ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আছে।
ছাত্রশিবিরের প্যানেলের ৩৬ দফা ইশতেহারের সাতটিতে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আছে নানা প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) প্যানেলের ইশতেহারে নারীদের হলগুলোতে খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মেয়েদের নামাজের স্থান সম্প্রসারণ, অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, জনপরিসর নারীবান্ধব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
উমামা-সাদী প্যানেল তাঁদের ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করা, আইনি সহায়তা সেল গঠন, সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন, অনলাইন-অফলাইনে নিপীড়ন বা বুলিংয়ের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিরোধ পর্ষদের প্যানেলের ইশতেহারে নারীবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি আছে।
বিভিন্ন প্যানেল যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তা পর্যালোচনাও করছেন ছাত্রীরা। তারা বলছেন, যাদের ভোট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ হবে, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে এবং সংঘাত কমবে– এমন প্রার্থীদের তারা বেছে নেবেন। পাশাপাশি নিরাপদ ক্যাম্পাস, মতপ্রকাশ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ছাত্রীদের বড় চাওয়া।
ভোটাররা যা বলছেন
এবারই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া নির্বাচন হচ্ছে। ডাকসু নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী সানজিদা আলম প্রভা বলেন, শিবির, ছাত্রদল কিংবা বাগছাস না দেখে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক– এটাই তিনি চান। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে প্রত্যাশা হলো, তারা যে কোনো মাতৃসংগঠনের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজের স্বতন্ত্রতা যেন বজায় রাখে।
ইংরেজি বিভাগের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাহসিন আলম বলেন, তিনি চান ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত হোক। তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারের জায়গা বুঝে নিতে পারবে। আর যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তারা তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। সুতরাং, তারা যেন রাজনৈতিক সহাবস্থান তৈরি করেন, কোনো বিরোধে যেন না জড়ান।
আপনার মতামত লিখুন :