আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। দিবসটির লক্ষ্য কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ, অধিকার সুরক্ষা এবং নেতৃত্ব বিকাশে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ বছরের প্রতিপাদ্য— ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই: সংকটের সামনের সারিতে মেয়েরা।’
তবে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের চিত্র এখনো উদ্বেগজনক। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর) অন্তত ৯৯৩ জন কন্যাশিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৩৫০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। একই সময়ে ৮১ কন্যাশিশু হত্যার শিকার হয়েছে। নির্যাতনের অন্যান্য ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে যৌন হয়রানি, পাচার, বাল্যবিবাহ ও শারীরিক নিপীড়ন।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
সম্প্রতি ফেনী সদর উপজেলায় ছয় বছরের এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার পর রাতের অন্ধকারে স্থানীয় একটি ইটভাটার সেপটিক ট্যাংক থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ১৮ বছর বয়সী এক শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। একইভাবে কক্সবাজারের টেকনাফে চার বছরের হুজাইফা নুসরাত আফসি হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। শিশুটির জন্মদিনের আগের দিনই বাড়ির পুকুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়। হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সোনার দুলের লোভে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৫৯টি। একই সময়ে নারী ও শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ২ হাজার ৭৪৪টি। তবে কন্যাশিশু ধর্ষণের আলাদা পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা হয়নি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী ও কন্যাশিশু মিলে মোট ২ হাজার ২৩৭ জন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ২৯ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের বয়স শূন্য থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
পিবিআইয়ের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ মামলার অভিযুক্তদের ২০.২৩ শতাংশ মাদকাসক্ত এবং ২৭.৩৮ শতাংশ পর্নোগ্রাফি আসক্ত। ভুক্তভোগীদের ৭২ শতাংশই শিশু বা শিক্ষার্থী, আর অভিযুক্তদের অধিকাংশই ছিল ভুক্তভোগীর আত্মীয় বা পরিচিত কেউ।
পারিবারিক সহিংসতাও কন্যাশিশুদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। চলতি বছরের নয় মাসে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় ৪৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে এক বাবা ছয় বছরের মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন—যা পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে বিচার বিলম্ব ও সামাজিক চাপের কারণে অনেক ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ জারি করে। এতে শিশু ধর্ষণের মামলার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিয়ের প্রলোভনে যৌন নিপীড়নকে নতুন ধারা হিসেবে যুক্ত করা, দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করা এবং ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, গত তিন দশকে কিছু অগ্রগতি হলেও বিশ্বের প্রায় সব দেশে কন্যাশিশুদের অধিকার এখনো লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণে ছেলেদের তুলনায় দ্বিগুণ ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শুধু আইনের প্রয়োগ নয়, বরং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবারভিত্তিক সুরক্ষা ব্যবস্থার জোরদার করাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর পথ।

আপনার মতামত লিখুন :