বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। বুধবার (৮ অক্টোবর) ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এতে দেশের বাজারেও স্বর্ণের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় গয়নার বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত আগস্টের তুলনায় এক ভরি স্বর্ণের দাম এখন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০ আগস্ট ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৫ টাকায়, যা বেড়ে বুধবার হয়েছে ১৭ হাজার ৯২৭ টাকা। অর্থাৎ এক মাসে প্রতি গ্রামে দাম বেড়েছে ২ হাজার ৯৮২ টাকা বা প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে এক ভরিতে বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৮২ টাকা। এভাবে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের স্বর্ণ কেনাবেচা প্রায় ৪০–৪৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তাঁদের দাবি, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশেও স্বর্ণ ধরে রাখতে দাম সমন্বয় করা ছাড়া উপায় নেই, না হলে তা চোরাই পথে বাইরে চলে যাবে। ঐতিহ্যগতভাবে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সোনা ‘নিরাপদ সম্পদ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাতে পারে—এই পূর্বাভাসে ডলারের মান কমে যাচ্ছে, আর মুনাফা ধরে রাখতে বহু দেশ এখন সোনায় বিনিয়োগ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, ইউক্রেন সংঘাত এবং ইউরোপ-এশিয়ার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। চীন ও ভারত এই বিনিয়োগে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) দর নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, “স্বর্ণের দরে আমাদের হাত নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমরাও তা বাড়াতে বাধ্য হই, না হলে দেশে স্বর্ণ থাকবে না।” বাজুস বিশ্ববাজারের বিভিন্ন তথ্য ও আন্তর্জাতিক বুলিয়ন এক্সচেঞ্জের দরের সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিদিন দেশের স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে। ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে ব্যবহৃত স্বর্ণের বেশিরভাগই আসে অপ্রাতিষ্ঠানিক পথে—প্রধানত চোরাই আমদানি ও প্রবাসীদের শুল্কমুক্ত স্বর্ণের মাধ্যমে—যার সরবরাহ এখন কমে গেছে।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের রিয়া জুয়েলার্সের বিক্রয়কর্মী নূরে বুলবুল রনি জানান, ক্রেতার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এখন অনেকেই পুরোনো স্বর্ণ দিয়ে নতুন গয়না বানাতে আসছেন। আমিন জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপক বকুল দেবনাথ বলেন, “ক্রেতা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে মধ্যবিত্তরা সোনার গয়না কেনার স্বপ্নও দেখতে পারবে না।”
মোনা জুয়েলার্সের বিক্রয়কর্মী মাহফুজুর রহমান বলেন, “দাম এত বেড়েছে যে দোকানে এখন আগের মতো ভিড় হয় না। মানুষ ছোট দুল বা আংটিও কেনার সাহস পাচ্ছে না।” গ্রামীণ জুয়েলার্সের মালিক জাহিদুর রহমান জানান, “নতুন স্বর্ণের সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। দোকানে যা বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি খালি হয়ে যাচ্ছে।”
বাজুসের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান জানান, ঢাকার বাইরের দোকানগুলোতেও বিক্রি প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :