ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রায় দেড় বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন অন্য বিভাগের শিক্ষকরা। নিজ বিভাগের কোনো শিক্ষক এই দায়িত্ব নিচ্ছেন না, ফলে বিভাগটির প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে জটিলতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই এতে ভোগান্তি বাড়ছে, এবং বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে।
বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, চেয়ারম্যান পদটি সাধারণত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তবে ২০২৪ সালের জুন মাসে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহাম্মদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নিজ বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়।
তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকায় এবং তার করা রিটের কারণে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকরা চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিনকেই পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়। প্রথমে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদা ইরশাদ নাছির এ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও অনুষদের ডিন ড. তৈয়েবুর রহমান দায়িত্বে আছেন।
বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক জানান, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়ায় এবং তার রিট আদালতে বিচারাধীন থাকায় অন্য কেউ দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অনেকেই মনে করছেন, এই অবস্থায় দায়িত্ব নিলে পরবর্তীতে আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বিভাগের নেতৃত্ব কার্যত অনিশ্চয়তার মধ্যেই আছে।
একজন শিক্ষক বলেন, “বিভাগের স্থবিরতার মূল কারণ হলো তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতা। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় শিক্ষকরা দায়িত্ব নিতে সংকোচ বোধ করছেন। এতে বিভাগীয় কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভুগছেন।”
বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, “আমরা চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য গেলেও অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। ডিন স্যার অনেক ব্যস্ত, তাই বিভাগীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে পাওয়া যায় না। নিজের বিভাগের কেউ চেয়ারম্যান থাকলে এসব সমস্যা হতো না।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। পরে বিষয়টি তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে পাঠানো হয়। সেই তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. ডালিয়া পারভীন বলেন, “তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে চলছে। অভ্যন্তরীণ তদন্তের তথ্য প্রকাশ করার এখতিয়ার আমাদের নেই। যখন প্রয়োজন হবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হবে।”
বিভাগের পরবর্তী ক্রমানুসারে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও অধ্যাপক ড. এস. এম. শামীম রেজার চেয়ারম্যান হওয়ার কথা থাকলেও দুজনেই দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, “চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখতিয়ার। আমি এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানি না।” অন্যদিকে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তে আমি এ দায়িত্ব পালন করছি। অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আদালতের বিষয়টি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তাই স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপাতত অনুষদ থেকেই দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, কিছু মতবিরোধ রয়েছে। কেউ চান বর্তমান ব্যবস্থা চলুক, কেউ চান নিয়মিত চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হোক। তবে আমাদের লক্ষ্য হলো—সমস্যার দ্রুত সমাধান ও বিভাগে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।”
বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়, তাহলে চেয়ারম্যান নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। তাছাড়া, ডিনের ব্যস্ততার কারণে বিভাগের দৈনন্দিন কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য স্থায়ী চেয়ারম্যান নিয়োগই এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন দীর্ঘ সময় ধরে অন্য বিভাগের শিক্ষক দিয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নজির খুব কমই আছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও আইনি বাধার কারণে সৃষ্ট এই অচলাবস্থা এখন বিভাগের একাডেমিক অগ্রগতির বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আপনার মতামত লিখুন :