রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি এখন যুক্ত আছেন একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা প্রতিদিন দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী এই খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত আছেন। প্রতিদিন চার ঘণ্টার প্রতিটি শিফটে দায়িত্ব পালনের জন্য জনপ্রতি ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ ৫৬০ টাকা করে সম্মানী পান তারা।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়ে। সেসময় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এগিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। টানা ছয় দিন তারা দিন-রাত সড়কে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পরিস্থিতি আংশিক স্বাভাবিক হলেও, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সমস্যার মুখে পড়ে পুলিশ। তখন থেকে শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে “ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপ” (TAG) হিসেবে যুক্ত করা হয়। শুরুতে মাত্র ২৯১ শিক্ষার্থী এ কার্যক্রমে অংশ নিলেও বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় এক হাজারে দাঁড়িয়েছে। তারা রাজধানীর আটটি ডিভিশন এবং বিভিন্ন জোনে কাজ করছেন।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, TAG সদস্যরা মূলত পিক আওয়ারে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের প্রথম শিফট সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় শিফট বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে। প্রতিদিন যে সদস্যরা ডিউটিতে অংশ নেন, তাদের অনুপাতে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। প্রতিদিন একজন শিক্ষার্থী ভ্যাট-ট্যাক্স বাদে ৫০৫ টাকা এবং ট্যাক্সসহ ৫৬০ টাকা পান।
বনানী জোনের এক সদস্য নিশান হোসাইন জানান, আগস্টের প্রথম দিকে তারা টানা ১৫ দিন সড়কে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ফিটনেস পরীক্ষা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে TAG সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি মনে করেন, পড়াশোনার পাশাপাশি এরকম খণ্ডকালীন চাকরি শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। শুধু ঢাকাতেই নয়, অন্যান্য বড় শহরেও এই উদ্যোগ চালু হওয়া উচিত।
অন্যদিকে অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শারীরিক ও মানসিক চাপও কম নয়। দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে কোমর ও পায়ে ব্যথা হয়, সারাদিন গাড়ির শব্দে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে পরিবহন চালকদের দুর্ব্যবহারও সহ্য করতে হয়।
মহাখালীতে দায়িত্ব পালনকারী মেহেদী হাসান বলেন, এই আয়ের ফলে পড়াশোনার খরচ, বই কেনা, ব্যক্তিগত হাতখরচ চালানো সহজ হয়। পাশাপাশি সামান্য হলেও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে। কদমতলীতে দায়িত্বে থাকা আবদুস সাত্তার জানান, এই কাজ করতে পেরে দেশের জন্য কিছু করার আনন্দ পান। আর প্রতিদিনের সম্মানী থেকে শিক্ষা খরচ মিটিয়ে পরিবারের জন্যও টাকা পাঠাতে পারছেন—এটিই তার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মো. আনিছুর রহমান জানান, বর্তমানে প্রায় এক হাজার TAG সদস্য রাজধানীতে কাজ করছেন। তারা প্রতিদিন ডিউটিতে যোগদানের ভিত্তিতে সম্মানী পান। তবে তাদের চুক্তি জুন থেকে জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। নতুন বাজেটে এই কর্মসূচি বহাল থাকবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. রফিকুল বলেন, TAG সদস্যদের সর্বদা নিরাপত্তা সচেতন থাকতে হবে। মাস্ক ব্যবহার, ধৈর্যশীল আচরণ এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
তেজগাঁও জোনের এডিসি ট্রাফিক তানিয়া সুলতানা জানান, শুরুতে তাদের জোনে ১৬০ জন সদস্য নিয়োগ দেওয়া হলেও বর্তমানে শতাধিক সদস্য সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকার ট্রাফিক সহায়তাকারী গ্রুপে যুক্ত হওয়া শিক্ষার্থীরা একদিকে দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখছেন, অন্যদিকে নিজেদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে পরিবারের প্রতিও সহায়তা করছেন। যদিও শারীরিক চাপ ও পেশাগত ঝুঁকি রয়েছে, তবুও অনেক শিক্ষার্থী এই খণ্ডকালীন চাকরিকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই দেখছেন।
আপনার মতামত লিখুন :