দাম ধরে রাখতে নিলামে ডলার কেনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সপ্তাহের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আরও ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার কেনা হয়েছে। মঙ্গলবার কেনা হয়েছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে দুই মাসের কম সময়ে ১১ দফায় দফায় ১১২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রাবাজারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পর ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৩ জুলাই থেকে ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থাৎ ডলারের দর যাতে কমে না যায় সেজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান।
তিনি বলেন, বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনছে। বৃহস্পতিবার ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার কেনা হয়েছে।
আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ (এফএক্স) নিলাম কমিটির মাধ্যমে মাল্টিপল প্রাইস অকশন পদ্ধতিতে এই ডলার কেনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আরিফ খান বলেন, “ডলার দর বেড়ে যাওয়াও অর্থনীতির জন্য ভালো নয়, আবার কমে যাওয়াও ভালো নয়। তাই এ বাজারকে ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে ডলার কিনছে। তাতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য প্রবাহ বাড়ছে।”
এর আগে ১০ ধাপে বিভিন্ন দামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৯৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ১৩ জুলাই প্রথম দফায় ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
১৫ জুলাই ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে তারা কেনে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ কোটি ডলার কেনে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে।
৭ আগস্ট কেনা হয় চার কোটি ৫০ লাখ ডলার। প্রতি ডলারের দাম পড়ে ১২১ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। ১০ আগস্ট পঞ্চম দফায় ১২১ টাকা ৪৭ পয়সা দরে কেনা হয় ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
১৫ আগস্ট কেনা হয় ১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২৯ আগস্ট কেনা হয় ১৫ কোটি ডলার।
টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে আমদানি বিল পরিশোধে সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে ডলার বিক্রি করত, সেখানে এখন চলছে উল্টো প্রবাহ।
গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছর পর্যন্ত গত তিন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ২৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করেছে, যা মূলত জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানি বিল মেটাতে ব্যবহার হয়েছে।
রিজার্ভ আরও বেড়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দিন শেষে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
গত ২৭ আগস্ট মোট রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আকুর মে-জুন মেয়াদের ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ কদরে। এরপর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গ্রস হিসাবে নামে ২৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে।
আকুর দেনা শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। আর গ্রস হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে; তখন অবশ্য রিজার্ভ বেশ খানিকটা কমে আসবে।
আকু হলো এশিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার নয়টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তার মূল্য প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি করা হয়।
আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। এর মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশগুলো থেকে বেশি পরিমাণে ডলার আয় করে। অন্যদিকে বেশিরভাগ দেশকেই আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় হিসাবে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।
ব্যাংকগুলো আমদানির খরচ নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়, যা রিজার্ভে যোগ হয়। তবে ওই দায় দুই মাস পরপর রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়।
ব্যাংকারা বলছেন, রেমিটেন্স ও রপ্তানির প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি নিলামে ডলার কেনার বিষয়টিও রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
ডলার কেনার প্রভাব রিজার্ভে পড়ার তথ্য দিয়ে গত ৩১ জুলাই ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, আগামীতে প্রয়োজন পড়লে আরও ডলার কেনা হবে।
চলতি বছর মে মাসে ডলার বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার মাধ্যমে তা বাজারভিত্তিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, আইএমএফের চাপে নয়, বরং বাজার বিবেচনায় নিয়ে তা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ ছাড়ের আগে আইএমএফের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশের পক্ষে আলোচনার মধ্যে ডলার দরকে বাজারভিত্তিক করে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল সংস্থাটি।
জুলাইতে ডলার দর হঠাৎ কমতে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার দর অস্থিতিশীল হতে দিবে না। দাম অনেক বেড়ে যাওয়া যেমন ভালো নয়, আবার দাম কমে যাওয়াও অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বমুখী ধারা ধরে রাখতে ডলারের দরের পতন ঠেকাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা উদ্বৃত্ত ডলার কেনা হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ খান।
আপনার মতামত লিখুন :