ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ব্রাকসু নির্বাচনের পথে বাধা আইন

বেরোবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫

ব্রাকসু নির্বাচনের পথে বাধা আইন

ছবিঃ আমার ক্যাম্পাস

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও হয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নির্বাচন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিকার আদায়, গণতান্ত্রিক চর্চা, ন্যায্য দাবি আদায়সহ বিভিন্ন কারণে ছাত্র সংসদের দাবি জানিয়ে আসছেন।

গত ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা
এবং ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচনে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে সমাপ্ত হলো (ডাকসু) নির্বাচন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের কোনো বিধান রাখা হয়নি। যার কারণে নির্বাচন করতে হলে প্রথমে ছাত্র সংসদ আইনের খসড়া একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পাস করে তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে হবে। বিধানটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংযুক্ত হলে তারপরেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনে-২০০৯ এ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নীতিমালা যুক্ত করার জন্য কাজ শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট কর্তৃক ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিমিত্তে ছাত্র সংসদ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসাব নম্বরে অর্থ সংরক্ষণ করা, ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুমোদন হলে যথা শীঘ্রই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে।

নেই ছাত্র সংসদ তবুও আদায় অর্ধ কোটি টাকা! 

এই বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ২০০৯ সালের সংসদীয় বিধান অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিধান রাখা হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বে-আইনিভাবে ছাত্র সংসদ বাবদ ফি আদায় করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্ধ কোটিরও বেশি টাকা কোথায়, কিভাবে বা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে সে হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতকে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের থেকে ২০০ টাকা এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ছাত্র সংসদ বাবদ ফি আদায় করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত স্নাতক পর্যায়ে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থীরও বেশি ভর্তি হয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। সে হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত ফি এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ লাখেরও বেশি। এ নিয়েও ক্ষোভ আছে শিক্ষার্থীদের মাঝে।

তবে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিমিত্তে ছাত্র সংসদ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসাব নম্বরে অর্থ সংরক্ষণ করছেন বলে জানান। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চেয়ে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপির প্রদান করেন শিক্ষার্থীরা।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে লিফলেট বিতরণ, ব্যানার টাঙানো ও রাস্তায় লিখন কর্মসূচি পালন করেন তারা। গত ১২ আগস্ট শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে পাঁচ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। এরপর আইনে ছাত্র সংসদ সংযুক্ত করে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবিতে ৫৯ ঘন্টা অনশন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর উপাচার্যের আশ্বাসে আমরণ অনশন প্রত্যাহার করেছেন শিক্ষার্থীরা।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গঠনতন্ত্রের জন্য কমিটি গঠন 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কর্তৃক গত ১৪ই মে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কতৃক খসড়া গঠনতন্ত্রটি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর কাছে প্রেরণ করেন। ইউজিসি দীর্ঘ আড়াই মাস পরে গত ৩০ শে জুলাই খসড়া গঠনতন্ত্রটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদনের জন্য খসড়া সংবিধানটি পরীক্ষা ও চূড়ান্তকরণ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান কে আহবান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট  কমিটি গঠন করেন। 

বেরোবি ছাত্র সংসদ গঠনতন্ত্র অনুমোদনে ঢাকায় বৈঠক


ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) গঠনের খসড়া গঠনতন্ত্র পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য গঠিত কমিটি  (২১ আগস্ট) ঢাকায় বৈঠক করেছে। 

সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দিন খান। এসময় উপস্থিত ছিলেন বেরোবির সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিক, ইইই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ফেরদৌস রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ইউজিসির পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান, উপসচিব (লিগ্যাল) নূরনাহার বেগম শিউলী এবং সিনিয়র সহকারী সচিব (লিগ্যাল) শেখ আনিসুজ্জামান।

ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে না থাকলেও রোডম্যাপ ঘোষণা

ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে না থাকলেও নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ এবং রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গত ১৭ আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনের উত্তরে গেটে আমার অনশন করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের অনশন ভাঙ্গাতে এই রোডম্যাপ এবং নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মো.শওকাত আলী। আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। ভোট গ্রহণ শুরু হবে ২৬ হতে ৩০ অক্টোবরের যেকোনো একদিন এবং সরকার কর্তৃক গেজেট প্রকাশ মাত্রই এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে এবং বিস্তারিত তফসিল ঘোষণা করা হবে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর অভিমত

অনশন করা শিক্ষার্থীরা বলেন, ১৭ বছর পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একবারও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। 

বেরোবি শাখ ছাত্রদলের আহ্বায়ক আমিন আল-আমিন বলেন, আমরা শুরু থেকেই ছাত্র সংসদের পক্ষে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করে আসছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত নেই। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এটিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি কমিটি করেছে এবং এটি প্রক্রিয়াধীন। অতি দ্রুত গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্র সংসদের রোডম্যাপ ঘোষনা করা হোক এবং গণতান্ত্রিক চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করা হোক।

বেরোবি শাখা শিবিরের সভাপতি সুমন সরকার বলেন, ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাদের দাবি গুলো জানাতে পারবে। তাই অতিদ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়া উচিত। বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই দাবির প্রতি সংহতি জানাই।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা বলেন 

এ বিষয়ে  বেরোবির উপাচার্য ড. মো. শওকাত আলী জানান, ছাত্র সংসদ নিয়ে সংবিধি পরীক্ষা ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে ইউজিসি দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা সম্ভাব্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছি। আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২৬ থেকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে যেকোনো একদিন ভোটগ্রহণ হতে পারে।"

উপাচার্য আরও বলেন, “গেজেট প্রকাশের পরই চূড়ান্ত তফসিল ঘোষণা করা হবে। সরকার গেজেট প্রকাশ মাত্রই প্রয়োজনীয় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া হবে।”

ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) গঠনের খসড়া গঠনতন্ত্র পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য গঠিত কমিটিরসদস্য ও বেরোবির সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিক বলেন, আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের খসড়া আইন নিয়ে আমরা ইউজিসির মেম্বারদের সাথে তিনটি মিটিং করেছি। তিন মিটিংয়ে আমাদের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আইনের মোটামুটি সব কাজ শেষ। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে খসড়া আইন পাশ হলে এটি আবার ইউজিসি বরাবর পাঠানো হবে এবং ইউজিসি এটা আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এটা বানানের কারেকশনের জন্য বাংলা একাডেমির কাছে পাঠানো হবে তারপর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করবেন। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিধি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংযুক্ত হবে। 

ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীরা সংশয় আছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া নিয়ে কোন সংশয় নেই। ছাত্র সংসদ আইন নিয়ে যেই জজেরা কাজ করছেন তারাই বললেন খসড়া আইনটি সিন্ডিকেটের পাশ করে আনতে। আমরা চাই না খসড়া আইনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসুক। আমরা আশা করছি  নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন দিতে পারব। এই মাসে আইনের কাজ শেষ হলে সামনে মাসে নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন দিতে পারব। ছাত্র সংসদের বিষয়ে ইউজিসির কারো কোন অনীহা ছিলনা। আইন হতে সময় লাগে তাই দেরি হচ্ছে তবে নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন হবে।

আমার ক্যাম্পাস/ইউনুচ রাতুল

Link copied!