বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নর্থব্রুক হল, যা স্থানীয়দের কাছে লালকুঠি নামেই বেশি পরিচিত, নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংস্কারকাজের অংশ হিসেবে ভবনটির ঐতিহ্যবাহী নাট্যমঞ্চটি ভেঙে ফেলার পর সেখানে জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে—যা নিয়ে উদ্বেগ ও প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাস ও সংস্কৃতি-মনস্ক নাগরিকেরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত এই স্থাপনাটি মোগল ও ইউরোপীয় রেনেসাঁর স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য সংমিশ্রণ। ১৮৭৪ সালে ঢাকায় সফররত তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের স্মরণে ঢাকার প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ভবনটি নির্মিত হয়। ১৮৮০ সালের ২৫ মে এটি উদ্বোধন করেন নর্থব্রুক নিজেই। লাল রঙের কারণে ভবনটি পরে ‘লালকুঠি’ নামে জনপ্রিয়তা পায়।
কালের পরিক্রমায় নর্থব্রুক হল হয়ে ওঠে ঢাকার সংস্কৃতি চর্চা ও সামাজিক আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। এর অভ্যন্তরের বিশাল নাট্যমঞ্চে নিয়মিত নাটক, সভা-সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় সফরে এসে এখানেই অবস্থান করেন এবং সম্মাননা গ্রহণ করেন।
তবে সময়ের সাথে সাথে ভবনটি হারায় তার জৌলুস। মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রন্থাগারের বহু মূল্যবান বই নষ্ট হয়, পাকিস্তান আমল থেকেই অবহেলা বাড়ে। ২০১৬ সালে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে পুরনো কারুকাজ অক্ষুণ্ণ রেখে সংস্কারকাজের শেষ পর্যায়ে রয়েছে নর্থব্রুক হল। তবে সংস্কারের অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী নাট্যমঞ্চটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যা নিয়ে অনেকেই বিস্মিত। স্থানীয়দের দাবি, “মঞ্চটি শুধু স্থাপনার অংশ ছিল না, এটি ছিল ঢাকার সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রতীক।”
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডালি কনস্ট্রাকশন-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী বিপ্লব কুমার জানান, “পুরোনো ভবন হওয়ায় কাজ কিছুটা সময় নিচ্ছে, তবে প্রায় শেষ পর্যায়ে। মাসখানেকের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।”
সংস্কারের পর ভবনটির ভেতরে নর্থব্রুক হলের ইতিহাস, নির্মাতা ব্যক্তিবর্গের ছবি ও দলিল সংরক্ষণ করে জাদুঘর হিসেবে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হারুন বলেন, “পুরনো কারুকাজ রেখে সংস্কার করা হচ্ছে, তবে মঞ্চটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগে এখানে নাটক ও সেমিনার হতো, আমরা অংশ নিতাম। এখন সেটি না রাখায় আফসোস লাগছে।”
একইভাবে শিক্ষার্থী দীপ্ত দাস প্রস্তাব দেন, “জাদুঘরটি উন্মুক্ত হলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার রাখা যেতে পারে, এতে ইতিহাসচর্চার আগ্রহ বাড়বে।”
এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, “নর্থব্রুক হল সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। তারা স্থাপত্য পরামর্শকের সহযোগিতায় কাজটি করেছে।”
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, “মঞ্চটি আসলেই খুলে ফেলা হয়ে থাকলে তা সংরক্ষণ করা হবে। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।”
সংস্কারের পর নর্থব্রুক হল আবারও তার নান্দনিক রূপে ফিরছে, তবে নাট্যমঞ্চ হারানোর এই সিদ্ধান্ত—ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক শূন্যতা তৈরি করেছে বলে মনে করছেন নগর ইতিহাসবিদরা।
আপনার মতামত লিখুন :